গাঁদা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ফুল। সাধারণত: এটি শীতকালীন ফুল হলেও বর্তমানে এটি গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালেও চাষাবাদ হয়ে থাকে। গাঁদা ফুল বিভিন্ন জাত ও রঙের দেখা যায়। বাগানের শোভা বর্ধন ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বন ও গৃহসজ্জায় এর ব্যাপক ব্যবহার ফুলটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
গুণাগুণঃ ক্ষত ও আঘাতে এর পাতার রস অত্যন্ত কার্যকরী। পাতার রস কান পাকা রোগ ছাড়াও ছত্রাকনাশক হিসেবে বেশ কার্যকরী। গাঁদা ফুলের নির্যাস টিউমারের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। গাঁদা ফুলের নির্যাস ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। জমিতে গাঁদা গাছের শুকনা গুড়া বা অপ্রয়োজনীয় অংশ প্রয়োগ করে নেমাটোডের মতো মারাত্মক রোগের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের তেল ও সুগন্ধী তৈরিতে গাঁদা ফুল ব্যবহৃত হয়।
যেসব এলাকায় বেশি পরিমাণে চাষ হয়ঃ যশোরের গদখালী, ঝিকরগাছা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর জেলার সদর উপজেলা, চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী ও পটিয়া, ঢাকা জেলার সাভার এলাকায় বাণিজ্যিকভিত্তিতে গাঁদা ফুলের চাষাবাদ হচ্ছে।
জাতঃ বহু প্রজাতি থাকলেও গাঁদা ফুলের জাতকে প্রধানত: দু’ভাগে ভাগ করা যায় ।
- আফ্রিকান গাঁদা-ইনকা, গিনি গোল্ড, ইয়েলা সুপ্রিম, গোল্ডস্মিথ, ম্যান ইন দি মুন, ইত্যাদি;
- ফরাসী গাঁদা-মেরিয়েটা, হারমনি, লিজন অব অনার, ইত্যাদি।
এছাড়াও বাংলাদেশে সাদা গাঁদা, জাম্বো গাঁদা এবং রক্ত বা চাইনিজ গাঁদার চাষ হয়ে থাকে।
গাছের বৃদ্ধি ও ফুল উৎপাদনঃ গাঁদা গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফোটা প্রধানত: দিনের দৈর্ঘ্য ও তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। পরিমাণমতো মাটির রস ও পুষ্টি উপাদানও গাছের বৃদ্ধি ও ফুল ফোটার জন্য প্রয়োজন। দিনের দৈর্ঘ্য বেশি হলে এবং স্বল্প তাপমাত্রায় (১২ থেকে ২১ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড) আফ্রিকান গাঁদা ভালোভাবে ফোটে এবং এর জীবনকালও বেশি হয়।
মাটি ও পরিবেশঃ এঁটেল দো-আঁশ মাটি বেশি উপযোগী, তবে যত্নসহ চাষ করলে যে কোন ধরণের মাটিতেই চাষ করা যেতে পারে। পানি জমে না এমন উর্বর অমস্ন (পি এইচ ৭.০ হতে ৭.৫) মাটি গাঁদা চাষের জন্য ভাল। ফরাসী গাঁদা খুবই নিকৃষ্ট মাটিতে ভাল হলেও আফ্রিকান গাঁদা চাষের জন্য পর্যাপ্ত সার দিতে হবে। জমিতে যেন পানি জমে না থাকে এবং জমিতে যাতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। গাঁদা চাষের জন্য মৃদু আবহাওয়া প্রয়োজন।
বংশ বিস্তারঃ গাঁদা ফুলের বংশ বিস্তার বীজ বা কাটিংয়ের মাধ্যমে করা যায়। বীজ থেকে যে গাছ হয় তা স্বাস্থ্যবান, লম্বা ও অধিক ফলনশীল হয় বলে সাধারণত: বীজের মাধ্যমেই বংশ বিস্তার করা হয়। তবে জাতের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে হলে অবশ্যই কাটিং বা অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তারই সহজ ও ভাল।
চারা উৎপাদনঃ সাধারণত: দু’ভাবে গাঁদা ফুলের চারা উৎপাদন করা যায়-
- বীজের মাধ্যমেঃ বীজের মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলার মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। বীজতলায় নিয়মিত পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে বীজতলায় যেন পানি জমে না থাকে। চারাগুলো ১.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি লম্বা হলে আগা কেটে দিলে চারা অতিরিক্ত লম্বা হয় না এবং সবল থাকে। এক মাস বয়স হলে চারাগুলো মূল জমিতে রোপণ করা যাবে।
- কাটিংয়ের মাধ্যমেঃ ফুল দেওয়া শেষ হলে সবল ও সুস্থ গাছ নির্বাচন করে তা থেকে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি লম্বা ডাল কেটে নিতে হবে। কাটিংগুলো পরে ছায়াযুক্ত স্থানে বালি ও মাটির মিশ্রণে ১ থেকে ১.৫ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করতে হবে এবং নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। এতে কাটিংয়ে খুব তাড়াতাড়ি শিকড় গজাবে। পরে গাছগুলো টবে বা জমিতে লাগাতে হবে।
চারা রোপণঃ কাটিং বা বীজ থেকে প্রাপ্ত চারা বর্ষার শেষে মূল জমিতে বা টবে রোপণ করতে হবে। ৩ থেকে ৪ পাতা বিশিষ্ট সবল চারা রোপণের জন্য ভাল। বিকালে যখন রোদের তাপ কমে যাবে তখন জমিতে চারা রোপণ করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২ হাত এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৬ ইঞ্চি। চারাগুলো লাগানোর আগে পাত্রে পানি নিযে দুই চা চামচ ডায়াথেন- এম ৪৫ ওষুধ মিশিয়ে চারাগুলো ঐ পানিতে ভিজিয়ে ৫ থেকে ৬ মিনিট পর তুলে লাগালে চারার মৃত্যুহার অনেক কম হবে।
ফুল উৎপাদনঃ গাঁদা ফুল সারা বছরে তিনবার উৎপাদন করা যায়।
ফুল দেয়ার সময় | বপন সময় | চারা রোপণ সময় |
বর্ষাকাল | জুনের মাঝামাঝি | জুলাই এর মাঝামাঝি |
শীতকাল | সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি | অক্টোবরের মাঝামাঝি |
গ্রীষ্মকাল | জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি | ফেব্রুয়ারি-মার্চ |
সার প্রয়োগ
সারের নাম | পরিমাণ (একর প্রতি) |
পচা গোবর | ১৫০০০ থেকে ২০০০০ |
ইউরিয়া | ১০০ কেজি |
টিএসপি | ৮০ কেজি |
এমওপি | ৬০ কেজি |
জিপসাম | ৪০ কেজি |
দস্তা | ৩ কেজি |
বিঃদ্রঃ চারা রোপণের ৩০ থেকে ৪৫ দিন পর একরপ্রতি ৭০ কেজি ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
চাষের সময়ে পরিচর্যাঃ চারা লাগানোর ৮ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত কোন কিছু করতে হবে না। জমিতে বা বীজতলায় চারা লাগানোর পর আগাছা বেশি হয়, গাঁদা ফুলের জমিতে নিড়ানি দিয়ে সমসত্ম জমি কুপিয়ে দিতে হবে, তারপর প্রতি একরে ৬০ কেজি হাওে ডিএমপি সার শুধু গাছের সারির মধ্যে ছিটিয়ে দিয়ে সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার পর যে চারা গুলো মারা যাবে, সেই জায়গায় অন্য জায়গা থেকে চারা এনে পূরণ করতে হবে। চারা যখন বড় হবে তখন গাছের গোড়ায় মাটি দিতে হবে। গাঁদার জন্য অপেক্ষাকৃত কম সেচের প্রয়োজন, তবে ফুল আসার পর সেচ দিলে ফুল বড় হয় এবং ফুলের রং ভালো হয়। জমিতে সেচ সাধারণত: খুব ভোরে অথবা সন্ধ্যার আগে দিতে হবে, প্রচন্ড রোদে জমিতে সেচ দেওয়া যাবে কারণ এত চারার ক্ষতি হয়। গাছে বেশি ফুল পেতে চাইলে ‘‘স্টপিং পদ্ধতিতে’’ গাছের ডগা কেটে দিতে হবে। এতে গাছে ডালপালা ও বেশি ফুল হবে। বড় আকারের ফুল পেতে হলে একটি বা দু’টি কুঁড়ি রেখে বাকি গুলো ফেলে দিতে হবে, ফুল বেশি বড় হলে গাছে খুঁটি দিতে হবে। চারা অবস্থায় ‘ডায়থেন এম-৪৫’ এবং ‘রোভরাল’ এই দুই প্রকার ওষুধ অনুমোদিত মাত্রায় স্প্রে করলে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হবে। গাছের তাড়াতাড়ি বুদ্ধিও জন্য থিওভিট ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে, গাছে কুঁড়ি আসলে থিওভিট দেওয়া বন্ধ করতে হবে। যে ফুল ফোটে না অর্থ্যাৎ পাঁপড়ি হয় না, সেই সমসত্ম পুরুষ গাছ তুলে ফেলতে হবে।
স্টপিং পদ্ধতিঃ রোপণ করা চারা বাড়তে থাকলে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি উপরে মাথা কেটে দিতে হবে। পরে যে ডাল বের হবে, তার মধ্য থেকে ২ থেকে ৩ টি ডাল রেখে তাতে ফুল ফোটাতে হবে। এবং গাছকে যতটুকু পারা যায় খাটো রাখতে হবে। এটাই স্টপিং পদ্ধতি বলে।
পোকামাকড় ও রোগবালাইঃ গাঁদা গাছ অনেক পোকা-মাকড়ের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে বলে এতে পোকার উপদ্রব নেই বললেই চলে। তবে এতে কিছু রোগের আক্রমণ দেখা যায়, যেমন-উইল্ট, কান্ড পচা ইত্যাদি।
রোগবালাই
গাঁদা ফুলের গোড়া পচা রোগঃ ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়। জলাবদ্ধ জমির গাঁদা ফুলের গাছে গোড়া পচা রোগ বেশি দেখা যায়। গাছের শিকড়ে পচন ধরে। গাছ নেতিয়ে পড়ে ও মরে যায়।
ব্যবস্থাপনাঃ জমির পানি বের করে দেওয়ার ভাল ব্যবস্থা করতে হবে এবং জমিতে সেচ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেন কোন মতেই পানি জমে না থাকে। রোগাক্রান্ত গাছ সমূলে তুলে তা ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট বা অনুমোদিত অন্য ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
গাঁদা ফুলের কান্ড পচা রোগঃ ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়। প্রথমে কান্ডে পানি ভেজা দাগ পড়ে। পরে দাগগুলি একত্রিত হয়ে গাছের কান্ডে পচন দেখা দেয়। গাছে পানি ও খাদ্য চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়, ফলে রোগাক্রান্ত গাছ ঝিমিয়ে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়।
ব্যবস্থাপনাঃ ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করার জন্য জমিতে ভাসিয়ে (পস্নাবন) সেচ দেওয়া যাবে না। চাষের আগে টবে বা বাগানে চারা রোপণের আগে মাটিতে ভালোভাবে রোদ খাওয়াতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট বা অনুমোদিত অন্য ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড়ঃ গাঁদা ফুলের পোকার আক্রমণ নেই বললেই চলে। গাঁদা গাছ অনেক পোকামাকড়ের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধী হিসাবে কাজ করে। অনেক সময় গাঁদা ফুলের জমিতে শামুকের উপদ্রব হয়। দেখা মাত্রই শামুক তুলের ফেলতে হবে এবং জমিতে চুন ছিটিয়ে শামুক দমন করতে হবে।
ফুল সংগ্রহঃ ফুল আকারে বড় হলে একটু লম্বা বোঁটা রেখে কাঁচি দিয়ে ফুল কাটাতে হবে। এতে ফুল বেশিক্ষণ তাজা থাকবে। ফুল সংগ্রহের জন্য ভোর (সকালের রোদ বৃদ্ধি পাওয়ার আগেই ফুল তোরা শেষ করতে হবে) বা বিকালের ঠান্ডা আবহাওয়া ভাল। ফুল সংগ্রহের আগে জমিতে সেচ দিলে সংগ্রহের পর ফুল অনেক বেশি সময় সতেজ থাকবে। সঠিকভাবে যত্ন নিলে ৭০ থেকে ৮০ দিনের মধ্যেই ফুল সংগ্রহ করা যাবে।
ফলনঃ জাত, রোপণ দূরত্ব, সময়, সার প্রয়োগ প্রভৃতির উপর গাঁদার ফলন নির্ভর করে। ভালভাবে যত্ন নিলে আফ্রিকান গাঁদার একর প্রতি প্রায় ৪ হাজার ৫০০ শত থেকে ৭ হাজার কেজি এবং ফরাসী গাঁদার ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব।
উত্তর সমূহ